বৃহস্পতিবার, ৮ মার্চ, ২০১২

আশি হাজার

কেউ যদি এখন আমার হাতব্যাগটা খোলে, দেখবে ওতে আশি হাজার টাকা আছে! কড়কড়ে হাজারের নোটে নগদ আশি হাজারটা টাকা এখন আমার হাতব্যাগে দোল খাচ্ছে!
আমার এখন আলিবাবার অবস্থা হয়েছে, কোথাও গিয়ে যে মনের সুখে টাকাগুলোর গায়ে ১টু হাত দোব; সেটি হচ্ছে না! হোস্টেলে ফিরে লোকের সামনে তো আর এত দিস্তে দিস্তে টাকা বের করা যায় না!
লোকে বলে- কিছু পেতে নাকি কিছু দিতে হয়! তবে এত টাকা পেতে আমায় খুব বেশি টাকা লাগাতে হয়নি! ৮০০ টাকা লাগিয়ে ৮০,০০০ তুলেছি! নিজের এলেমে নিজেই নিজের পিঠ চাবড়ে দিলাম।
কিন্তু টাকাটা রাখি কোথায়? ব্যাঙ্কে রাখলে ট্যাঁপায় ধরবে, ব্যাগে রাখলে প্রশ্ন উঠবে আর বাড়িতে রাখলে মা কি বলবে?
খুব গরম লাগছে, মুম্বাইতে ঠা ঠা রোদ্দুর হয় না বটে; তবে যা হয়, গা ঘামিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট! ১টা পেপসি খাব নাকি, রোদে শুকিয়ে গলাটা চুলকুচ্ছে!! খাইই না, ৮০টা হাজার টাকা তো আছে পকেটে; চিন্তা কি? ট্রেন থেকে নেমে রাস্তা ধরলাম!
ছোট্ট ফুটপাথের দোকান, এখানে সবার সামনে টাকা বের করা কি ঠিক হবে? কেউ যদি দেখে ফ্যালে? দেখে যদি পেছু নেয়? দূর! আর যেতে পারছি না! সন্তর্পণে ব্যাগের চোরা পকেটে হাত ঢুকিয়ে ১টা হাজারী নোট তুলে আনলুম! পেপসি চাইতেই দোকানদার বল্ল- 'চেঞ্জ দিজিয়েগা ম্যাডাম, ছুট্টা নেহি হ্যায়'! সর্বাঙ্গ জ্বলে গ্যালো! টাকা হাতে মণ্ডা খেতে চাইলেও অ্যাতো ঝ্যামেলা! খুব ১টা কড়া গালি দিতে গিয়েও মিঠে হেসে বললাম- 'নেহি হ্যায় ভাইসাব, বড়ি পিয়াস লাগি হ্যায়! দেখিয়ে না, হোতা হ্যায় তো...' লোকটা ১গাল 'হায় হায়' করে আমার দিকে ঠাণ্ডায় জমজমে ১টা পেপসি ধরিয়ে দিল!
আঃ! এর নাম তেষ্টা, আর এইই হল তেষ্টার শান্তি! ১গাদা খুচরো বাজেয়াপ্ত করে হাঁটা লাগালাম! এবার কি করি?
৮০ টা হাজার টাকা আছে ব্যাগে, কিছুই কি খচ্চা করবনি?? কি কিনি, কি কিনি করছি। এমন সময়ে পথ আটকে দাঁড়াল ১টা ভিখিরি, কোলে আবার ১টা বাচ্চা! এসেই নাকি সুরে ভিক্ষার বাঁধা বোল ধরল! শুনেই মাথায় ১টা রসিকতা খেলে গ্যালো! কেউ ২ঘণ্টায় ১০হাজার কামায়, আর কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ১ই সুরে ১ই ভাবে ২টো টাকার জন্য ঝুলোঝুলি করে! আচ্ছা, আমি কি বদলে দিতে পারিনা ওর ভাগ্য, আজকের মত? আজকের মত আমি কি ওর ভগবান হতে পারি না? ইদিক-সেদিক ইতি-উতি তাকিয়ে আবার তুলে আনলাম ১টা হাজারের নোট, জুলজুল চোখে সেটা পাচার করে দিলুম ভিখিরি ঠাকরুন-এর হাতে! ভিখিরিটা কি বুঝল কে জানে, বোকা বোকা চোখে নোট-টা টেনে নিয়ে ছুট লাগালে নুতুন ভিখ-দেউনি'র খোঁজে! আঃ মোলো যা! দুনিয়াটা কি বদখত হয়ে যাচ্ছে দিন কে দিন! ১টা থ্যাঙ্ক ইউ অব্দি বললে না! ধ্যাত্তেরি!

সামনে অটো দেখতে পে উঠে পড়লাম! অটোওয়ালা ব্যাস্ত হাতে মিটার নামিয়ে বল্ল- 'কিধার যানে কা'? এই রেঃ! এই জায়গাটাই তো চিনিনে!মুখ রাখতে অটোওয়ালা-র চোখে চোখ রেখে বললাম- 'ইধার কোই মল হ্যায় কেয়া'? অটোওয়ালা বল্ল- 'হ্যায় না ম্যাডাম'। আমি আর সুযোগ দিলাম না, 'তো চলিয়ে' বলে আরাম করে বসলাম! অটোওয়ালা চললে অটো চাগিয়ে! বেশ ভাল জায়গাটা! শুনেছি, মুম্বাইতে নাকি টাকা ওড়ে আকাশে-বাতাসে! চিরকাল সেই উড়ন্ত টাকাগুলো-কে ধরার স্বপ্ন দেখেছি! আর আজ ওগুলোকে ধরতে পেরে মন চাইছে অমনি করে আমিও টাকা উড়িয়ে দেই! কারন- এখন, আমিও পারি!
মল এসে গ্যালো, নেমে অটোওয়ালা-কে আরেকটা হাজারের নোট ধরিয়ে দিলাম! হাজারের নোট পে অটোওয়ালা বেশ খুসিই হল, ব্যাটাচ্ছেলে-র কাছে বেশি খুচরা হয়েছে বোধয়! যাক গে! দেয়ার পর খেয়াল হল, আরে আমার কাছে তো ভাঙ্গানি ছিলই! যাক গে!
মল-টা খুব ১টা বড় নয়, তবে শপারস স্টপ আছে! আমার জন্য যথেষ্ট! কিন্তু বেশি খচ্চা করা যাবে না! টাকা জমাতে হবে এবার; হোস্টেলে আর থাকব না, নুতুন বাড়িভাড়া নেব ১টা! নিজের মত থাকব! মনে মনে খরচটা ছকে নিয়ে ঢুকে পড়লাম! সারি সারি জামাকাপড়, সুগন্ধি- যাদের দিকে অ্যাদ্দিন শুধু তাকিয়ে থেকেছি! ১টা সুগন্ধি কেনা যায় না, রইস হওয়ার জন্যই তো করছি এসব! কিনিই না! ৮০হাজার তো কামিয়েছি এই ২দিনে! কিনে ফেললাম ডেভিডফ-এর 'কুল ওয়াটার', অবশ্যই মেয়েদেরটা! খুব ১টা খসল না যদিও, এইই২০০০ টাকা মত। আমার কাছে সেটা এখন এমন বেশি কিছু নয়!
বেরিয়েই সত্য পল-এর দোকান! কোনদিন চোখ তুলেও এসবে নজর দেব ভাবিনি! কিন্তু আজ? এখন? আমি ৮০হাজারের মালকিন! আচ্ছা, কত দাম হবে সত্য পল-এর স্কার্ফ-এর? ৮০হাজারেরও বেশি হবে কি?? ১বুক সাহস নিয়ে ঢুকে পড়লাম, লক্ষ্য করলাম ৩জন মহিলা দৌড়ে এলেন মাল দ্যাখাতে! উঃ! স্কার্ফের কি বাহার! কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনি? ভেবেচিন্তে ১টা পছন্দ করলাম! পকেটে যে ভালরকম ১টা ফোস্কা পড়ল, বুঝে গেলাম! কি আর করা?
এবার কি করি? আচ্ছা, এখানে ১টা বিজলি গ্রিল আছে না? কতদিন ভাল বাঙ্গালী রান্না খাইনি! ঢুকে পড়লাম বিজলি গ্রিলে, দারোয়ান-টা ১টু তাকাল কি? এটা হল রইস বাঙ্গালিদের খাওয়ার আড্ডা! লক্ষ্য করলাম, এরা কেউই বাংলা বলছে না! আমি অবশ্য বসেই হাভাতের মত বললাম- 'ডাব চিংড়ি আছে?' আমার বাংলা শুনে আশপাশের বাঙ্গালী গুলো ঘুরে তাকাল! আমি ওদের তাকানি-কে ফুতকারিয়ে দিয়ে বেয়ারা-কে বললাম- 'লিখুন, ডাব চিংড়ি-চিতল পেটি আর সাদা ভাত! আর মিষ্টি কি আছে?' অর্ডার দিয়ে বসে বসে নিজের ভাগ্যের কথাটা ভাবছিলুম! পাতি মধ্যবিত্তের মে আমি, সোম থেকে শনি মাছ খেয়েছি, রোববারে মুরগি আর মাসে ১দিন পাঁঠা! আর আজ? আমি এখন ১কিলো পাঁঠার চেয়েও বেশি দামে ১৫০গ্রাম ডাব চিংড়ি কিনি, বিজলি গ্রিল থেকে! খুব মুরগি করেছি ঐ মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে!
কত কিছু চেয়েছি জীবনের কাছে; ছোট ছোট স্বপ্ন, ছোট ছোট সুখ। সুখ-এর যাতনা মেটাতে গোপন অসুখ! ১টা ভিডিও ক্যামেরার খুব শখ ছিল আমার, যেমনি করে ঐ বিলু (বিলিতি)রা ১টা ছোট কাঁধব্যাগ নিয়ে শহর ঘুরে ঘুরে ক্যামে জীবন তোলে, সেইরকম! আর নিজের ১টা ছোট্ট বাসা; নিজের মতন, রাত্রি-যাপন! আর ১টা টাটা ন্যানো! লোকে যতই বলুক- 'আমরা ন্যানো কিনব ক্যানো?' আমার কিন্তু খুব পছন্দ। ক্যানো? বিন-এর গাড়ি বলে। মিস্টার বিন, তারও তো এরকম ছোট বাড়ি-ছোট গাড়ি! নিজের মতন, একলা জীবন! অমন আমার হয় না?
ভাবতে ভাবতে খাওয়ার এসে গ্যালো! খুব খিদে পেয়েছিল, ফুড়ুৎ করে উড়ে গ্যালো!
রাস্তায় বেড়িয়ে মনে হলো, মায়ের জন্য কোনদিনও কিছু ত্যামন...
ছোটবেলায় আমি মায়ের শাড়ি গুনতাম। ১টা-২টো-৩টে-৪টে-২০০টা! মাকে বলতাম- 'ও মা! তোমার তো অনেক শাড়ি'! মা হাসত, তফাৎ-টা সেদিন বুঝলাম যেদিন মামীর আলমারিটা দেখলাম!
মায়ের জন্য ১টা শাড়ি কিনে ফেললাম! আচ্ছা, ৮০হাজার টাকা যখন কামালামই, ১টা হ্যান্ডিক্যাম কিনে ফেলাটা কি ঠিক হবে না? কে জানে আবার কবে এমন টাকা হবে? দৌড়ে মলে ঢুকলাম! তারপর ১ ছুটে ই-জোন! দামী বাহারি ১টা হ্যান্ডিক্যাম কিনলাম! এতগুলো টাকা নগদে দিতে দেখে লোকটা অবাক চোখে তাকাল! হ্যান্ডিক্যাম নিয়ে পথে নেমে সে কি আনন্দ! আচ্ছা, হ্যান্ডিক্যাম-টা কি বের করব? ঐ বিলুদের মত শহরটাকে ধরব নাকি ক্যামেরার চোখ দিয়ে? না বাপু! লজ্জা করে! বাড়ি গিয়ে আগে সব বুঝেসুজে নিই, তারপর না হয়...
এত মাল নিয়ে ট্রেনে যাওয়া ঠিক নয় বাবা! ট্যাক্সি ডাকি, না না রেডিও ক্যাব! ক্যাবে উঠে দম নিলাম, ক্যাব উড়ে চলেছে মুম্বাইএর রাজপথ ধরে, আর চড়চড় করে মিটারের কাঁটাও নড়ে চলেছে! সে যাক গে, ২দিনে ৮০,০০০ টাকা কামানো মেয়ের এটুকু বিলাস সাজে! এরপর থেকে তো আমি শুধু রেডিও ক্যাবই চড়ব! কি কি কিনেছি, আরেকবার বরং নেড়েচেড়ে দেখি! এই স্কার্ফ-টা গলায় দিয়ে স্কার্ট-এর সাজে যখন ডেভিডফ লাগিয়ে যাব, আমায় দেখে কি 'ওপরওয়ালা'-দের চোখ পিছলোবে না? অফিসের ঐ চকচকে ছেলেটা, ও কি আমায় প্রপোজ করবে?
বাড়ির কাছে ক্যাব থামিয়ে গুপ্ত ধনের খোঁজে ব্যাগে হাত ঢোকাতেই মাথাটা বন করে ঘুরে গ্যালো! আর ১টাও হাজারের নোট নেই, এদিকে মানিব্যাগে টিমটিম করছে দেড়শ-টা টাকা! হায় ভগবান! দামী মল-সত্য পল পেরিয়ে এসে ট্যাক্সিআলার কাছে ভরাডুবি? কিন্তু কোথায় গ্যালো বাকি টাকাগুলো? একে একে মনে পড়ে গ্যালো খচ্চার লিস্টি! কিন্তু এখন কি করি, টাকা কই পাই? এ-টি-এম নিয়ে যাব নাকি? তাইই যাই! এ-টি-এম থেকে টাকা মিটিয়ে মনে পড়ল পেপসি খাওয়ার বাকি খুচরো-টা পকেটেই ছিল!

আবার আবার শুন্য আমি, ফেরত টু পাতি মধ্যবিত্ত! ভাবতেই পারছি না ২দিনের কামানো ৮০হাজার আমি ১দিনেই! কিন্তু ক্যানো ক্যানো পাতি মধ্যবিত্ত আমি? পাতি মধ্যবিত্তের কি অ্যাতো আগুন থাকে? ১টা পাতি মধ্যবিত্ত মেয়ে কি পারে 'ছেলেধরা' হয়ে উঠতে, মেয়েলিয়ানা ভাঙ্গিয়ে খেতে?
ভাবতেই মনে জোর এল। সত্যিই তো, ভয়টা আমার কিসের? সামনের শনিবার, আরও ৮০হাজার!

৫টি মন্তব্য:

  1. Namaskar, Amar nam Zawed, kolkatai thaki... apnar blog dekhe ekhane account banalam... sobcheye prothome ei bolg tiy chokhe porlo.. 80 Hazar... purota porlam... jante khub ichha hochhe tai jiggasa kore nilam.. Oto gulo taka kotha diye kamalen? koutuhol boshotoy jiggasa korlam, rag korben na...

    Eti,
    Zawed

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক বছর আগে কোথায় একটা পড়েছিলাম যে এইসব শহুরে Escort-রা রাত-প্রতি ৩০-৪০,০০০/- টাকা কামায়। যেমনি পড়া, তেমনি লেখা!
      এটা যদিও অনেক পুরনো লেখা; প্রায় ৮-৯ বছর আগের। লেখার খাতা হারিয়ে যাবার ভয়ে এখানে রেখেছি।

      মুছুন
  2. ভালো লেখা। আমার অফিসও মুম্বাইয়ে। তাই অনেকটাই রিলেট করতে পারলাম। প্রথম যখন এসেছিলাম তখন শহরটাকে মনে হত একটা বড়সড় ডাস্টবিন। এখন আমি মুম্বাইকে ভারতের সবচেয়ে সভ্য, সবচেয়ে আধুনিক শহর মনে করি। এই শহর ইউনিক, এমনকি দিল্লি তার সাজানো গোছানো হাইওয়ে, ঝাঁ-চকচকে মেট্রোরেল নিয়েও মুম্বাইয়ের তুলনায় আসে না, অন্য সব শহরকে তো ছেড়েই দিলাম।
    তবে একটা কথা। '১টা পাতি মধ্যবিত্ত মেয়ে কি পারে 'ছেলেধরা' হয়ে উঠতে, মেয়েলিয়ানা ভাঙ্গিয়ে খেতে?' -এখানটায় ঠিক কি বলতে চেয়েছেন বুঝতে পারলাম না।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. "ছেলেধরা" হল Escort; আর, "মেয়েলিয়ানা ভাঙ্গিয়ে খাওয়া" বলতে ওইই ছলা-কলা মাখিয়ে টাকা কামানো'র কথাই বলতে চেয়েছি।
      অনেক বছর আগে কোথায় একটা পড়েছিলাম যে এইসব শহুরে Escort-রা রাত-প্রতি ৩০-৪০,০০০/- টাকা কামায়। যেমনি পড়া, তেমনি লেখা!
      এটা যদিও অনেক পুরনো লেখা; খাতা হারিয়ে যাবার ভয়ে এখানে রেখেছি।

      মুছুন
  3. Du dine 80hajar!baapre!source of income ta ki! Per day 40hajar! Keu to r gorib thakbena tale to dese.

    উত্তরমুছুন